preloader
  • কর্মযোগ, স্বামী বিবেকানন্দ

কর্মযোগ হল স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বই। এটি ইংরেজি ভাষায় ১৮৯৬ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর ও ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে নিউ ইয়র্ক সিটির ২২৮ ওয়েস্ট ৩৯তম স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে বিবেকানন্দ কয়েকটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বন্ধু ও সমর্থকরা জোসেফ সোসিয়া গুডউইন নামে এক পেশাদার স্টেনোগ্রাফারকে (ইনি পরে বিবেকানন্দের শিষ্য হয়েছিলেন) নিযুক্ত করেন। গুডউইন কয়েকটি বক্তৃতা রেকর্ড করে রাখেন। এগুলিই ১৮৯৬ সালে কর্মযোগ বইটিতে প্রকাশিত হয়।

এই বইয়ের মূল আলোচ্য হল কর্ম ও কর্মযোগ। স্বামী বিবেকানন্দ ভগবদ্গীতার কর্মযোগ ধারণাটি আলোচনা করেছেন। বিবেকানন্দ কর্মযোগকে একটি ধর্মপথ বলে উল্লেখ করে বলেন, এই পথে মানুষ যেমন জগতের প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে পারে, তেমনি জ্ঞানার্জনও করতে পারে।

উদ্ধৃতি

কর্ম-রহস্য অবগত হওয়াই কর্মযোগ।

“যদি কেউ দর্শনের একটা সূত্রও না পাঠ করে, যদি সে ঈশ্বরের অস্তিত্বেই না বিশ্বাস করে, এবং যদি সারা জীবনে একবারও ঈশ্বরের আরাধনা না করে, তবু শুভ কর্মসমূহের সরলক্ষমতা তাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে পরের জন্য সে তার জীবন ও অন্য সব কিছুই উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে । এক্ষেত্রে একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তার আরাধনার মাধ্যমে আর একজন দার্শনিক তার জ্ঞানের জন্য যে বিন্দুতে পৌঁছবে সেও সেই বিন্দুতেই পৌঁছতে সক্ষম । সুতরাং তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে দার্শনিক, কর্মী ও ভক্ত সকলে একই বিন্দুতে মিলিত হয়; আর সেই বিন্দুই হচ্ছে আত্মোৎসর্গীকৃত হওয়া।” –স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ, ষষ্ঠ অধ্যায়, প্যারা ৮

নিঃস্বার্থপরতা ও সৎকর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ

অতএব কর্মযোগ নিঃস্বার্থপরতা ও সৎকর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করিবার একটি ধর্ম ও নীতিপ্রনালী। কর্মযোগীর কোন প্রকার ধর্মমতে বিশ্বাস করিবার আবশ্যকতা নাই। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করিতে পারেন, আত্মা-সম্বন্ধে অনুসন্ধান না করিতে পারেন, অথবা কোন প্রকার দার্শনিক বিচারও না করিতে পারেন, কিছুই আসে যায় না। তাঁহার বিশেষ উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থপরতা লাভ করা এবং তাঁহাকে নিজ চেষ্টাতেই উহা লাভ করিতে হইবে। তাঁহার জীবনের প্রতি মুহূর্তই হইবে উহার উপলব্ধি, কারণ জ্ঞানী যুক্তিবিচার করিয়া বা ভক্ত ভক্তির দ্বারা যে সমস্যা সমাধান করিতেছেন, তাঁহাকে কোনপ্রকার মতবাদের সহায়তা না লইয়া কেবল কর্মদ্বারা সেই সমস্যারই সমাধান করিতে হইবে। (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

আসক্তি হইতেই দুঃখ আসে

কর্মযোগ কি বলে?-বলে, ‘নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু কর্মে আসক্তি ত্যাগ কর।’ কোন কিছুর সহিত নিজেকে জড়াইও না। মনকে মুক্ত রাখো। যাহা কিছু দেখিতেছ, দুঃখ-কষ্ট-সবই জগতের অপরিহার্য পরিবেশ মাত্র।; দারিদ্র্য ধন ও সুখ ক্ষণস্থায়ী, উহারা মোটেই আমাদের স্বভাবগত নয়। আমাদের স্বরূপ দুঃখ ও সুখের পারে-প্রত্যক্ষ বা কল্পনার অতীত; তথাপি আমাদিগকে সর্বদাই কর্ম করিয়া যাইতে হইবে। ‘আসক্তি হইতেই দুঃখ আসে, কর্ম হইতে নয়।’ যখনই আমরা কর্মের সহিত নিজেদের অভিন্ন করিয়া ফেলি, তখনই আমরা দুঃখ বোধ করি, কিন্তু কর্মের সহিত ঐরূপ এক না হইয়া গেলে সেই দুঃখ অনুভব করি না। …(স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

কার্য-কারণ-শৃঙ্খলের বাহিরে যাওয়া

বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়-সমুদয় নিয়মের বাহিরে যাওয়া, কার্য-কারণ-শৃঙ্খলের বাহিরে যাওয়া; আর যেখানেই এই জগৎ আছে, সেখানেই কার্য-কারণ-শৃঙ্খল বর্তমান। (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

বন্ধনগুলিকেই ঐ বন্ধন ভাঙিবার উপায়রূপে ব্যবহার

কিন্তু এই জগতের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা বড় কঠিন ব্যাপার। অতি অল্প লোকেই এই আসক্তি ত্যাগ করিতে পারে। আমাদের শাস্ত্রে আসক্তি-ত্যাগের দুইটি উপায় কথিত হইয়াছে। একটিকে বলে নিবৃত্তিমার্গ-উহাতে ‘নেতি নেতি’ (ইহা নয়, ইহা নয়) করিয়া সব ত্যাগ করিতে হয়; আর একটিকে বলে প্রবৃত্তিমার্গ-উহাতে ‘ইতি ইতি’ করিয়া সকল বস্তু গ্রহণ করিয়া তাহার পর ত্যাগ করা হয়। নিবৃত্তিমার্গ অতি কঠিন। উহা কেবল উন্নতমনা অসাধারণ প্রবল-ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। তাঁহারা শুধু বলেন, ‘না, আমি ইহা চাই না’; শরীর ও মন তাঁহাদের আজ্ঞা পালন করে, এবং তাঁহারা সাফল্যমন্ডিত হন। কিন্তু এরূপ মানুষ অতি বিরল। অধিকাংশ লোক তাই প্রবৃত্তিমার্গ-সংসারেরই পথ বাছিয়া লয়; এবং বন্ধনগুলিকেই ঐ বন্ধন ভাঙিবার উপায়রূপে ব্যবহার করে। ইহাও একপ্রকার ত্যাগ, তবে ধীরে ধীরে-ক্রমশঃ ত্যাগ করা হয়। সমস্ত পদার্থকে জানিয়া, ভোগ করিয়া, এইরূপে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া, সংসারের সকল বস্তুর প্রকৃতি অবগত হইয়া মন অবশেষে ঐগুলি ছাড়িয়া দেয় এবং অনাসক্ত হয়। অনাসক্তি-লাভের প্রথমোক্ত মার্গের সাধন-বিচার, আর শেষোক্ত পথের সাধন-কর্ম ও অভিজ্ঞতা। প্রথমটি জ্ঞানযোগের পথ, কোন প্রকার কর্ম করিতে অস্বীকার করাই এ পথের বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়টি কর্মযোগের পথ, এ পথে কর্মের বিরতি নাই। এই জগতে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই কর্ম করিতে হইবে। কেবল যাঁহারা সম্পূর্ণরূপে আত্মতৃপ্ত, যাঁহারা আত্মা ব্যতীত আর কিছুই চান না, যাঁহাদের মন কখনও আত্ম হইতে অন্যত্র গমন করে না, আত্মাই যাঁহাদের সর্বস্ব, শুধু তাঁহারাই কর্ম করিবেন না। অবশিষ্ট সকলকে অবশ্যই কর্ম করিতে হইবে। (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

স্বার্থপরতার প্রবণতা বিনষ্ট কর

অতএব কর্মযোগে বলা হয়, প্রথমে এই স্বার্থপরতার জাল বিস্তার করিবার প্রবণতা বিনষ্ট কর, যখন উহা দমন করিবার শক্তি লাভ করিবে, তখন মনকে আর স্বার্থপরতার তরঙ্গে পরিণত হইতে দিও না। তারপর সংসারে গিয়া যত পারো কর্ম কর, সর্বত্র গিয়া মেলামেশা কর, যেখানে ইচ্ছা যাও, মন্দের স্পর্শ তোমাকে কখনই দূষিত করিতে পারিবে না। পদ্মপত্র জলে রহিয়াছে, জল যেমন কখনও উহাতে লিপ্ত হয় না, তুমিও সেইভাবে সংসারে থাকিবে; ইহাই ‘বৈরাগ্য’ বা অনাসক্তি। মনে হয়, তোমাদিগকে বলিয়াছি যে, অনাসক্তি ব্যতীত কোন প্রকার ‘যোগ’ই হইতে পারে না। অনাসক্তি সকল যোগেরই ভিত্তি। একজন-সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়াও সম্পূর্ণ অনাসক্ত হইতে পারে, আর একজন হয়তো ছিন্নবস্ত্র-পরিহিত হইয়াই ভয়ানক আসক্ত। প্রথমে আমাদিগকে এই অনাসক্ত অবস্থা লাভ করিতে হইবে, তারপর নিরন্তর কার্য করিতে হইবে। যে কর্মপ্রণালী আমাদিগকে সর্বপ্রকার আসক্তি ত্যাগ করিতে সাহায্য করে, কর্মযোগ আমাদিগকে তাহাই দেখাইয়া দেয়। অবশ্য ইহা অতি কঠিন। …(স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

কর্তব্যের ভাব একেবারে দূর করিয়া দাও

কিন্তু যাঁহারা কর্মযোগী হইতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদিগকে কর্তব্যের ভাব একেবারে দূর করিয়া দিতে হইবে। তোমার আমার পক্ষে কোন কর্তব্যই নাই। জগৎকে যাহা দিবার আছে অবশ্যই দাও, কিন্তু কর্তব্য বলিয়া নয়। উহার জন্য কোন চিন্তা করিও না। বাধ্য হইয়া কিছু করিও না। বাধ্য হইয়া কেন করিবে? বাধ্য হইয়া যাহা কিছু কর তাহা দ্বারাই আসক্তি বর্ধিত হয়। কর্তব্য বলিয়া তোমার কিছু থাকিবে কেন? ‘সবই ঈশ্বর সমর্পণ কর।’ এই সংসার-রূপ ভয়ঙ্কর অগ্নিময় কটাহে-যেখানে কর্তব্যরূপ অনল সকলকে দগ্ধ করিতেছে, সেখানে এই অমৃত পান করিয়া সুখী হও। আমরা সকলেই শুধু তাঁহার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করিতেছি,পুরস্কার বা শাস্তির সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। যদি পুরস্কার পাইতে ইচ্ছা কর, তবে তাহার সহিত তোমাকে শাস্তিও লইতে হইবে। শাস্তি এড়াইবার একমাত্র উপায়-পুরস্কার ত্যাগ করা, কারণ উভয়ে একসূত্রে গ্রথিত। একদিকে সুখ, আর একদিকে দুঃখ। একদিকে জীবন, অপরদিকে মৃত্যু। মৃত্যুকে অতিক্রম করিবার উপায়-জীবনের প্রতি অনুরাগ পরিত্যাগ করা। জীবন ও মৃত্যু একই জিনিস, শুধু বিভিন্ন দিক হইতে দেখা। অতএব ‘দুঃখশূন্য সুখ’ এবং ‘মৃত্যুহীন জীবন’ কথাগুলি বিদ্যালয়ের ছেলেদের ও শিশুগণের পক্ষেই ভাল, কিন্তু চিন্তাশীল ব্যক্তি দেখেন, বাক্যগুলি স্ববিরোধী, সুতরাং তিনি দুই-ই পরিত্যাগ করেন। যাহা কিছু কর, তার জন্য কোন প্রশংসা বা পুরস্কারের আশা করিও না। …(স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

কর্মের সমুদয় ফল ত্যাগ কর

কর্মের সমুদয় ফল ত্যাগ কর, সৎকর্মের জন্যই সৎকর্ম কর, তবেই কেবল সম্পূর্ণ অনাসক্তি আসিবে। এইরূপে হৃদয়-গ্রন্থি ছিন্ন হইবে, এবং আমরা পূর্ণ মুক্তি লাভ করিব। এই মুক্তিই কর্মযোগের লক্ষ্য।" (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৭ম অধ্যায়)

অনাসক্ত হও

অতএব একমাত্র উপায়-সমুদয় কর্মের ফল ত্যাগ করা, অনাসক্ত হওয়া। এইটি জানিয়া রাখোঃ জগৎ আমরা নয়, আমরাও এই জগৎ নই; বাস্তবিক আমরা শরীরও নই, আমরা প্রকৃতপক্ষে কর্ম করি না। আমরা আত্মা-চিরস্থির, চিরশান্ত। আমরা কোন কিছুর দ্বারা বদ্ধ হইব? আমাদের রোদনেরও কোন কারণ নাই, আত্মার পক্ষে কাঁদিবার কিছুই নাই। এমন কি, অপরের দুঃখে সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াও আমাদের কাঁদিবার কোন প্রয়োজন নাই। এইরূপ কান্নাকাটি ভালবাসি বলিয়াই আমরা কল্পনা করি যে, ঈশ্বর তাঁহার সিংহাসনে বসিয়া এইরূপে কাঁদিতেছেন। ঈশ্বর কাঁদিবেনই বা কেন? ক্রন্দন তো বন্ধনের চিহ্ন-দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের জল যেন না পড়ে। এইরূপ হইবার উপায় কি? ‘সম্পূর্ণ অনাসক্ত হও’-বলা খুব ভাল বটে, কিন্তু হইবার উপায় কি? অভিসন্ধি-শূন্য হইয়া যে-কোন ভাল কাজ করি, তাহা আমাদের পায়ে একটি নূতন শৃঙ্খল সৃষ্টি না করিয়া যে শৃঙ্খলে আমরা বদ্ধ রহিয়াছি, তাহারই একটি শিকলি ভাঙিয়া দেয়। আমরা প্রতিদানে কিছু পাইবার আশা না করিয়া যে-কোন সৎচিন্তা চারিদিকে প্রেরণ করি, তাহা সঞ্চিত হইয়া থাকিবে-আমাদের বন্ধন-শৃঙ্খলের একটি শিকলি চূর্ণ করিবে, এবং আমরা ক্রমশই পবিত্রতর হইতে থাকিব-যতদিন না পবিত্রতম মানবে পরিণত হই। কিন্তু লোকের নিকট ইহা যেন কেমন অস্বাভাবিক ও অত্যধিক দার্শনিক এবং কার্যকর অপেক্ষা বেশী তাত্ত্বিক বলিয়া বোধ হয়। আমি ভগবদ্‍গীতার বিরুদ্ধে অনেক যুক্তিতর্ক পড়িয়াছি, অনেকেই বলিয়াছেন-অভিসদ্ধি বা উদ্দেশ্য ব্যতীত মানুষ কাজ করিতে পারে না। ইহারা গোঁড়ামির প্রভাবে কৃত কর্ম ব্যতীত কোন ‘নিঃস্বার্থ’ কার্য কখন দেখে নাই, সেইজন্যই এইরূপ বলিয়া থাকে। (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৮ম অধ্যায়)

পরোপকার কর

আমাদিগকে পরোপকার করিতে হইবে; ইহাই আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রেরণা, কিন্তু আমাদের সর্বদাই জানা উচিত যে, পরোপকার করা এক পরম সুযোগ ও সৌভাগ্য। উচ্চ মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া পাঁচটি পয়সা লইয়া গরীবকে বলিও না, ‘এই নে বেচারা’, বরং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞ হও-ঐ গরীব লোকটি আছে বলিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া তুমি নিজের উপকার করিতে পারিতেছ। যে গ্রহণ করে সে ধন্য হয় না, যে দান করে সেই ধন্য হয়। (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৫ম অধ্যায়)

ভাল হও এবং ভাল কাজ কর

কিন্তু মহাপুরুষগণের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই বলিয়াছিলেন, ‘আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমাদের ভিন্ন ভিন্ন মত শুনিতে চাই না। আত্মা সম্বন্ধে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মতবাদ বিচার করিয়াই বা কি হইবে? ভাল হও এবং ভাল কাজ কর। ইহাই তোমাদের মুক্তি দিবে, এবং সত্য যাহাই হউক না, সেই সত্যে লইয়া যাইবে।’(স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৮ম অধ্যায়)

বুদ্ধ হও!

তিনিই (বুদ্ধ) প্রথম সাহসপূর্বক বলিয়াছিলেন, ‘কোন প্রাচীন পুঁথিতে কোন বিষয় লেখা আছে বলিয়া বা তোমার জাতীয় বিশ্বাস বলিয়া অথবা বাল্যকাল হইতে তোমাকে বিশ্বাস করিতে শেখানো হইয়াছে বলিয়াই কোন কিছু বিশ্বাস করিও না; বিচার করিয়া, তারপর বিশেষ বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখ-উহা সকলের পক্ষে উপকারী, তবেই উহা বিশ্বাস কর, ঐ উপদেশমত জীবনযাপন কর এবং অপরকে ঐ উপদেশ অনুসারে জীবনযাপন করিতে সাহায্য কর।’ যিনি অর্থ, যশ বা অন্য কোন অভিসন্ধি ব্যতীতই কর্ম করেন, তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাল কর্ম করেন; এবং মানুষ যখন এরূপ কর্ম করিতে সমর্থ হইবে, তখন সেও একজন বুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং তাহার ভিতর হইতে এরূপ কর্মশক্তি উৎসারিত হইবে, যাহা জগতের রূপ পরিবর্তিত করিয়া ফেলিবে। এরূপ ব্যক্তিই কর্মযোগের চরম আদর্শের দৃষ্টান্ত।" (স্বামী বিবেকানন্দ, কর্মযোগ ৮ম অধ্যায়)

দয়া করে অধ্যায় ভিত্তিক পড়তে নীচের লিঙ্ক দেখুন:

অধ্যায় ০১: কর্ম-চরিত্রের উপর ইহার প্রভাব

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :2400

কর্মের জন্যই কর্ম কর। সকল দেশেই এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁহাদের প্রভাব সত্যই জগতের পক্ষে কল্যাণকর ; তাঁহারা কর্মের জন্যই কর্ম করেন, নাম-যশ গ্রাহ্য করেন না, স্বর্গে যাইতেও চাহেন না। লোকের প্রকৃত উপকার হইবে বলিয়াই তাঁহারা কর্ম করেন। আবার অনেকে আছেন, যাঁহারা আরও উচ্চতর উদ্দেশ্য লইয়া দরিদ্রের উপকার ও মনুষ্য-জাতিকে সাহায্য করেন; কারণ তাঁহারা সৎকার্যে বিশ্বাসী, তাঁহারা সদ্‌ভাব ভালবাসেন। নাম-যশের উদ্দেশ্যে কৃত কর্মের ফল কখনও সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না; সচরাচর দেখা যায়, যখন আমরা বৃদ্ধ হই এবং আমাদের জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, তখন আমাদের নাম-যশ হয়। কিন্তু যদি কেহ কোন স্বার্থপূর্ণ উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ করে, সে কি কিছুই লাভ করে না? হাঁ, সে সর্বাপেক্ষা বেশী লাভ করে। নিঃস্বার্থ কর্মেই অধিক লাভ, তবে ইহা অভ্যাস করিবার সহিষ্ণুতা মানুষের নাই। সাংসারিক হিসাবেও ইহা বেশী লাভজনক। প্রেম, সত্য, নিঃস্বার্থপরতা-এগুলি শুধু নীতি-সম্বন্ধীয় আলঙ্কারিক বর্ণনা নয়, এগুলি আমাদের সর্বোচ্চ আদর্শ; কারণ এগুলির মধ্যেই মহতী শক্তি নিহিত রহিয়াছে।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০২: নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বড়

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :4800

কর্ম করা অথচ ফলাকাঙ্ক্ষা না করা, লোককে সাহায্য করা অথচ তাহার নিকট হইতে কোনপ্রকার কৃতজ্ঞতার প্রত্যাশা না করা, সৎকর্ম করা অথচ উহাতে নাম-যশ হইল বা না হইল, এ-বিষয়ে একেবারে দৃষ্টি না দেওয়া-এইটিই এ জগতে সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যাপার। জগতের লোক যখন প্রশংসা করে, তখন ঘোর কাপুরুষও সাহসী হয়। সমাজের অনুমোদন ও প্রশংসা পাইলে নির্বোধ ব্যক্তিও বীরোচিত কার্য করিতে পারে, কিন্তু কাহারও স্তুতি-প্রশংসা না চাহিয়া অথবা সেদিকে আদৌ দৃষ্টি না দিয়া সর্বদা সৎকার্য করাই প্রকৃতপক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বার্থত্যাগ।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৩: কর্মরহস্য

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :3100

গীতায় আমরা পুনঃপুনঃ পাঠ করি-আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে হইবে। সকল কর্মই স্বভাবতঃ শুভাশুভ-মিশ্রিত। আমরা এমন কোন কর্ম করিতে পারি না, যাহা দ্বারা কোথাও কিছু না কিছু ভাল হয়, আবার এমন কোন কর্ম হইতে পারে না, যাহা হইতে কোথাও না কোথাও কিছু অনিষ্ট হয়। প্রত্যেক কর্মই অপরিহার্যভাবে শুভাশুভ-মিশ্রিত, তথাপি শাস্ত্র আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে বলিতেছেন। শুভাশুভ উভয়ই নিজ নিজ ফল প্রসব করিবে। শুভ কর্মের ফল শুভ, অশুভ কর্মের ফল অশুভ হইবে; কিন্তু এই শুভাশুভ উভয়ই আত্মার বন্ধন। গীতায় ইহার এই মীমাংসা করা হইয়াছে যে, যদি আমরা কর্মে আসক্ত না হই, তবে কর্ম আমাদের বন্ধন হইতে পারিবে না।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৪: কর্তব্য কি?

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :2800

ভগব‍দ্‌গীতা জন্ম ও অবস্থা(বর্ণাশ্রম)-গত কর্তব্যের কথা বার বার উল্লেখ করিয়াছেন। বিভিন্ন কর্মের প্রতি কোন্ ব্যক্তির মনোভাব কিরূপ হইবে, তাহা ঐ ব্যক্তির বর্ণ আশ্রম ও সামাজিক মর্যাদা অনুসারেই অনেকটা নিরূপিত হয়। এইজন্য আমাদের কর্তব্য, যে সমাজে আমরা জন্মগ্রহন করিয়াছি, সেই সমাজের আদর্শ ও কর্মধারা অনুসারে এমন কাজ করা, যাহা দ্বারা আমাদের জীবন উন্নত ও মহৎ হয়। কিন্তু এটি বিশেষ ভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সকল সমাজে ও সকল দেশে একপ্রকার আদর্শ ও কার্যপ্রণালী প্রচলিত নয়। এই বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতাই এক জাতির প্রতি অপর জাতির ঘৃণার প্রধান কারণ।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৫: পরোপকারে নিজেরই উপকার

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :3200

তথাপি আমাদিগকে পরোপকার করিতে হইবে; ইহাই আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রেরণা, কিন্তু আমাদের সর্বদাই জানা উচিত যে, পরোপকার করা এক পরম সুযোগ ও সৌভাগ্য। উচ্চ মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া পাঁচটি পয়সা লইয়া গরীবকে বলিও না, ‘এই নে বেচারা’, বরং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞ হও-ঐ গরীব লোকটি আছে বলিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া তুমি নিজের উপকার করিতে পারিতেছ। যে গ্রহণ করে সে ধন্য হয় না, যে দান করে সেই ধন্য হয়। তুমি যে তোমার দয়া ও করুণাশক্তি জগতে প্রয়োগ করিয়া নিজেকে পবিত্র ও সিদ্ধ করিতে সমর্থ হইতেছ, এজন্য তুমি কৃতজ্ঞ হও। সব ভাল কাজই আমাদিগকে পবিত্র ও সিদ্ধ হইতে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৬: অনাসক্তিই পূর্ণ আত্মত্যাগ

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :3900

জগতের উপকার করিতে গিয়া প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেদেরই উপকার করিয়া থাকি। অপরের জন্য আমরা যে কার্য করি, তাহার মুখ্য ফল-আমাদের চিত্তশুদ্ধি। সর্বদা অপরের কল্যাণচেষ্টা করিতে গিয়া আমরা নিজেদের ভুলিবার চেষ্টা করিতেছি। এই আত্মবিস্মৃতিই আমাদের জীবনে এক প্রধান শিক্ষার বিষয়। মানুষ মূর্খের মতো মনে করে-স্বার্থপর উপায়ে সে নিজেকে সুখী করিতে পারে। বহুকাল চেষ্টার পর সে অবশেষে বুঝিতে পারে, প্রকৃত সুখ স্বার্থপরতার নাশে, এবং সে নিজে ব্যতীত অপর কেহই তাহাকে সুখী করিতে পারে না।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৭: মুক্তি

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :3900

বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়-সমুদয় নিয়মের বাহিরে যাওয়া, কার্য-কারণ-শৃঙ্খলের বাহিরে যাওয়া; আর যেখানেই এই জগৎ আছে, সেখানেই কার্য-কারণ-শৃঙ্খল বর্তমান। কিন্তু এই জগতের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা বড় কঠিন ব্যাপার। অতি অল্প লোকেই এই আসক্তি ত্যাগ করিতে পারে। আমাদের শাস্ত্রে আসক্তি-ত্যাগের দুইটি উপায় কথিত হইয়াছে। একটিকে বলে নিবৃত্তিমার্গ-উহাতে ‘নেতি নেতি’ (ইহা নয়, ইহা নয়) করিয়া সব ত্যাগ করিতে হয়; আর একটিকে বলে প্রবৃত্তিমার্গ-উহাতে ‘ইতি ইতি’ করিয়া সকল বস্তু গ্রহণ করিয়া তাহার পর ত্যাগ করা হয়। নিবৃত্তিমার্গ অতি কঠিন। উহা কেবল উন্নতমনা অসাধারণ প্রবল-ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। তাঁহারা শুধু বলেন, ‘না, আমি ইহা চাই না’; শরীর ও মন তাঁহাদের আজ্ঞা পালন করে, এবং তাঁহারা সাফল্যমন্ডিত হন। কিন্তু এরূপ মানুষ অতি বিরল। অধিকাংশ লোক তাই প্রবৃত্তিমার্গ-সংসারেরই পথ বাছিয়া লয়; এবং বন্ধনগুলিকেই ঐ বন্ধন ভাঙিবার উপায়রূপে ব্যবহার করে। ইহাও একপ্রকার ত্যাগ, তবে ধীরে ধীরে-ক্রমশঃ ত্যাগ করা হয়। সমস্ত পদার্থকে জানিয়া, ভোগ করিয়া, এইরূপে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া, সংসারের সকল বস্তুর প্রকৃতি অবগত হইয়া মন অবশেষে ঐগুলি ছাড়িয়া দেয় এবং অনাসক্ত হয়। অনাসক্তি-লাভের প্রথমোক্ত মার্গের সাধন-বিচার, আর শেষোক্ত পথের সাধন-কর্ম ও অভিজ্ঞতা। প্রথমটি জ্ঞানযোগের পথ, কোন প্রকার কর্ম করিতে অস্বীকার করাই এ পথের বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়টি কর্মযোগের পথ, এ পথে কর্মের বিরতি নাই। এই জগতে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই কর্ম করিতে হইবে।

আরও পড়ুন

অধ্যায় ০৮: কর্মযোগের আদর্শ

  • তারিখ :1 আগস্ট, 2021
  • শব্দ :3000

উপসংহারে অল্প কথায় তোমাদের নিকট এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে বলিব, যিনি কর্মযোগের এই শিক্ষা কার্যে পরিণত করিয়াছেন। সেই ব্যক্তি বুদ্ধদেব; একমাত্র তিনি ইহা সম্পূর্ণরূপে কার্যে পরিণত করিয়াছিলেন। বুদ্ধ ব্যতীত জগতের অন্যান্য মহাপুরুষগণের সকলেই বাহ্য প্রেরণার বশে নিঃস্বার্থ কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কারণ এই একটি ব্যক্তি ছাড়া জগতের মহাপুরুষগণকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারেঃ এক শ্রেণী বলেন-তাঁহারা ঈশ্বরের অবতার, পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন, অপর শ্রেণী বলেন-তাঁহারা ঈশ্বরের প্রেরিত বার্তাবহ; উভয়েরই কার্যের প্রেরণা-শক্তি বাহির হইতে আসে; আর যত উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাষা ব্যবহার করুন না কেন, তাঁহারা বহির্জগৎ হইতেই পুরস্কার আশা করিয়া থাকেন। কিন্তু মহাপুরুষগণের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই বলিয়াছিলেন, ‘আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমাদের ভিন্ন ভিন্ন মত শুনিতে চাই না। আত্মা সম্বন্ধে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মতবাদ বিচার করিয়াই বা কি হইবে? ভাল হও এবং ভাল কাজ কর। ইহাই তোমাদের মুক্তি দিবে, এবং সত্য যাহাই হউক না, সেই সত্যে লইয়া যাইবে।’ তিনি আচরণে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত-অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন; আর কোন্ মানুষ তাঁহা অপেক্ষা বেশী কাজ করিয়াছেন? ইতিহাসে এমন একটি চরিত্র দেখাও, যিনি সকলের উপরে এত উর্ধ্বে উঠিয়াছেন! সমুদয় মনুষ্যজাতির মধ্যে এইরূপ একটিমাত্র চরিত্র উদ্ভূত হইয়াছে, যেখানে এত উন্নত দর্শন ও এমন উদার সহানুভূতি! এই মহান্ দার্শনিক শ্রেষ্ঠ দর্শন প্রচার করিয়াছেন, আবার অতি নিম্নতম প্রাণীর জন্যও গভীরতম সহানুভুতি প্রকাশ করিয়াছেন, নিজের জন্য কিছুই দাবি করেন নাই। বাস্তবিক তিনিই আদর্শ কর্মযোগী-সম্পূর্ণ অভিসন্ধিশূন্য হইয়া তিনি কাজ করিয়াছেন; মনুষ্যজাতির ইতিহাসে দেখা যাইতেছে-যত মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করিয়াছে, তিনিই তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। হৃদয় ও মস্তিষ্কের অপূর্ব সমাবেশ-অতুলনীয় বিকশিত আত্মশক্তির শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত! জগতে তিনিই প্রথম একজন মহান্ সংস্কারক। তিনিই প্রথম সাহসপূর্বক বলিয়াছিলেন, ‘কোন প্রাচীন পুঁথিতে কোন বিষয় লেখা আছে বলিয়া বা তোমার জাতীয় বিশ্বাস বলিয়া অথবা বাল্যকাল হইতে তোমাকে বিশ্বাস করিতে শেখানো হইয়াছে বলিয়াই কোন কিছু বিশ্বাস করিও না; বিচার করিয়া, তারপর বিশেষ বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখ-উহা সকলের পক্ষে উপকারী, তবেই উহা বিশ্বাস কর, ঐ উপদেশমত জীবনযাপন কর এবং অপরকে ঐ উপদেশ অনুসারে জীবনযাপন করিতে সাহায্য কর।’ যিনি অর্থ, যশ বা অন্য কোন অভিসন্ধি ব্যতীতই কর্ম করেন, তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাল কর্ম করেন; এবং মানুষ যখন এরূপ কর্ম করিতে সমর্থ হইবে, তখন সেও একজন বুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং তাহার ভিতর হইতে এরূপ কর্মশক্তি উৎসারিত হইবে, যাহা জগতের রূপ পরিবর্তিত করিয়া ফেলিবে। এরূপ ব্যক্তিই কর্মযোগের চরম আদর্শের দৃষ্টান্ত।

আরও পড়ুন